ভ্যাটের দরবেশ জাকিরের দুর্নীতি : খুঁটির জোড় কোথায় ?

- আপডেট সময় : ১২:২৫:৪৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ২৪ বার পড়া হয়েছে
ঢাকার শুল্ক বিভাগের মহাপরিচালক মুহম্মদ জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।
এই অভিযোগগুলোর তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে তদন্তের নামে সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে বহাল তবিয়তে রয়েছেন এই শুল্ক কর্মকর্তা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে জাকিরের খুঁটির জোড় কোথায়?
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ২১ ব্যাচের এই কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার আশীর্বাদেই তিনি ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের দায়িত্ব পান। প্রায় ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন ওঠে, যদিও সে সময় তা ধামাচাপা দেওয়া হয়। এ প্রকল্পের মাধ্যমেই তিনি ভ্যাট জাকির নামে পরিচিতি পান।
সম্প্রতি ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে দুদক। অভিযোগ রয়েছে, ওই প্রকল্পের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) কেনার কার্যাদেশ দেয়া হয় জাকির হোসেনের শ্যালকের প্রতিষ্ঠানের নামে। প্রতিষ্ঠানটি ১ লাখ ৩০ হাজার টাকার এসি সরবরাহ করে, যার প্রকৃত বাজারমূল্য অর্ধেকেরও কম।
এছাড়া ধ্রুপদী টেকনো কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
২০২৪ সালের ৮ জানুয়ারি দুদকে জমা দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়, বিদেশ ভ্রমণের নামে তিনি সরকারি ঋণের টাকা অপচয় করেছেন, সিনিয়র কর্মকর্তাদের প্রমোদ ভ্রমণে নিয়ে গেছেন এবং অবৈধ অর্থ সাদা করার জন্য নিজেকে লেখক হিসেবে পরিচিত করেছেন। তার লেখা বাংলাদেশের নতুন ভ্যাট নামে একটি বই রয়েছে, যার মূল্য ১ হাজার ৭৫০ টাকা (রকমারিতে ১ হাজার ৫০০ টাকা)।
অভিযোগে আরও বলা হয়, বেনাপোল কাস্টম হাউসে ফেব্রিক্স চালানের জালিয়াতি, চট্টগ্রাম ভ্যাটে অডিট প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্তিতে ভয় দেখানোসহ নানা অনিয়মে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। যশোর ভ্যাট কমিশনার থাকাকালে তার স্ত্রীর নামে একাধিক বন্ড প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অভিযোগ আছে। সে সময় তার স্ত্রী স্বর্ণবারসহ চোরাচালানে জড়িত থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে গোয়েন্দা সংস্থার হাতে ধরা পড়েছিলেন।
২০২২ সালে বনানী ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হতে গিয়ে পারটেক্স গ্রুপকে ভ্যাট নথিতে সুবিধা দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। সদস্যপদ নিতে যে ৩০ লাখ টাকা খরচ করেন, তা ২০২৩–২৪ করবর্ষের রিটার্নে দেখাননি। বর্তমানে বনানী ক্লাবের স্থায়ী সদস্য হিসেবে তিনি নিয়মিত মাসিক চাঁদা দিয়ে যাচ্ছেন।
২০২৪ সালের ২২ মে দুদক তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের পরও তার বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শিক্ষার্থী ও জনতার আন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৩১ ডিসেম্বর তিনি চট্টগ্রাম কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট থেকে বদলি হয়ে কমিশনার অব কাস্টমস, কাস্টম হাউস ঢাকায় যোগ দেন।
এরপর ঢাকায় যোগদানের পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ১ জুলাই ২০২৫ তারিখে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, তিনি ২১ ও ২৮ জুন নির্ধারিত কর্মদিবসে কাস্টম হাউস বন্ধ রেখে আমদানি–রপ্তানি কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করেন, যার ফলে সরকারের বিপুল রাজস্ব ক্ষতি হয়।
পরবর্তীতে ১৩ আগস্ট ২০২৫ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক অফিস আদেশে তাকে ঢাকা কাস্টমস হাউস থেকে বদলি করে মূল্য সংযোজন কর নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, ঢাকা মহাপরিচালক হিসেবে পদায়ন করা হয়।
তদন্ত ও অভিযোগ চলমান থাকা সত্ত্বেও বহাল তবিয়তে ঢাকার শুল্ক বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন মুহম্মদ জাকির হোসেন। এতে এনবিআর এবং কাস্টমসের সৎ কর্মকর্তাদের মধ্যে বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অনেকেরই প্রশ্ন ভ্যাটের দরবেশ জাকিরের খুঁটির জোড় কোথায়?
এসব অভিযোগের বিষয়ে মুহম্মদ জাকির হোসেনের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।